বুকে জ্বালাপোড়া বা এসিড রিফ্লাক্স! তাহলে জেনেনিন এর কারন, প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা

Written by News Desk

Published on:

বুকে জ্বালাপোড়া বা এসিড রিফ্লাক্স খুবই কমন একটি সমস্যা। প্রায় সবাই কোন না কোন সময় এই সমস্যার মুখোমুখি হয়। একে ইংলিশে হার্টবার্ণ বলা হলেও বাস্তবে এর সাথে হার্ট বা হৃদপিন্ডের কোন সম্পর্ক নেই। পাকস্থলির এসিড এই সমস্যার প্রধান কারন। যে এসিড আমাদের পাকস্থলীতে খাদ্য হজম করতে সাহায্য করে, সেটা খুব শক্তিশালী। আমাদের পাকস্থলী এটা সহ্য করতে পারে। তবে সেন্সিটিভ খাদ্যনালীর এটা সহ্য করতে কষ্ট হয়। এই এসিড সাধারণত পাকস্থলীর বাহিরে বের হয় না। তবে পাকস্থলীর উপরে যদি ত্রুটিযুক্ত কোন ভালভ থাকে, তাহলে এই এসিড পাকস্থলি থেকে বের হয়ে আসতে পারে। এটা পাকস্থলীর বাহিরে বের হলে শরীরের ভিতরে, বিশেষ করে গলায় একটা জ্বলা জ্বলা ভাব হয়। এটাকেই এসিড রিফ্লাক্স অথবা হার্টবার্ণ বলা হয়।

সাধারণত নিচের জিনিসগুলোর কারণে এসিড রিফ্লাক্স বা বুকে জ্বালাপোড়া হয়ঃ কিছু কিছু খাদ্য খাওয়া – যেমন কফি, এলকোহল, চকোলেট, পেঁয়াজ, ভাজা অথবা বেশি মসলাযুক্ত খাদ্য, কমলা ও লেবু, টমেটো ও টমেটো সস ইত্যাদি উত্কণ্ঠা বা মানসিক চাপ, বেশি খাওয়া, খাওয়ার পরেই শোয়া, কিছু কিছু ঔষধ খাওয়া। বুকে জ্বালাপোড়া বা এসিড রিফ্লাক্স হওয়ার সম্ভাবনা কমানোর উপায়ঃ

যদি আপনার ওজন বেশি হয়, তাহলে ওজন কমানোর চেষ্টা করুন। ওজন বেশি হলে পাকস্থলীর ওপর বেশি চাপ পড়ে এবং পাকস্থলী থেকে এসিড বের হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ঢিলা জামা পরিধান করুন। টাইট জামা পড়লে পাকস্থলীতে চাপ পড়ে এবং এসিড রিফ্লাক্স হতে পারে। যদি আপনার ধুমপানের অভ্যাস থাকে তাহলে ধুমপান ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করুন। যে মাংশপেশীটা পাকস্থলী থেকে এসিড বের হওয়া প্রতিরোধ করে, ধুমপান সেটাকে দুর্বল করে দেয়। কি কি ঔষধ আপনি খাচ্ছেন সেটা চেক করুন। নিয়মিত ব্যাথার ঔষধ খেলে এসিড রিফ্লাক্স হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যদি রাত্রে ঘুমানোর সময় এসিড রিফ্লাক্স হয় তাহলে খাটের মাথার দিক ১০-২০ সেন্টিমিটার উঁচু করুন, যাতে আপনার বুক এবং মাথা পেটের চেয়ে উপরে থাকে। এতে এসিড গলায় উঠতে পারবে না। রাত্রে ঘুমানোর দুই-তিন ঘন্টা আগে রাতের খাবার খান।

বুকে জ্বালাপোড়া বা এসিড রিফ্লাক্স প্রতিরোধে ঔষধ : উপরের পরামর্শগুলো পালনের পরেও যদি আপনার বুকে জ্বালাপোড়ার সমস্যা না যায়, তাহলে বেশ কিছু ঔষধ আছে যেগুলো আপনি সেবন করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, যেটা আপনার কাছে এসিড রিফ্লাক্স মনে হচ্ছে, সেটা অন্য কিছুও হতে পারে। তাই কোন ঔষধ খাওয়ার আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলা ভালো।

এসিড রিফ্লাক্স বা বুকে জ্বালাপোড়ার জন্য ঔষধ : এন্টাসিডঃ এসিড রিফ্লাক্স ভালো করার জন্য এটা সবচেয়ে পুরোনো এবং সবচেয়ে পরিচিত ঔষধ। কমদামী, দ্রুত কাজ করে এবং ঠিকমতো ব্যবহার করলে অধিকাংশ মানুষের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ হওয়ার কারণে এটা অত্যন্ত জনপ্রিয়।

যেভাবে এটা কাজ করেঃ এন্টাসিড আপনার পাকস্থলীর এসিডকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আপনার এসিড রিফ্লাক্স শুরু হওয়ার পরে আপনি এটা খেতে পারেন। মসলাদার খাদ্য খাওয়ার পরে যদি আপনার এসিড রিফ্লাক্সের লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে এন্টাসিড এর চেয়ে ভালো কোন বিকল্প নেই। কিছু কিছু এন্টাসিড ট্যাবলেট হিসাবে এবং কিছু কিছু সিরাপ হিসেবে বিক্রি হয়। ট্যাবলেট কাজ করতে একটু বেশি সময় নেয় এবং সিরাপের মত শক্তিশালী হয় না। দ্রুত জ্বালা কমানোর জন্য ট্যাবলেটকে ভালো করে চিবিয়ে গিলে নিতে পারেন।

যখন এটা কাজ করা শুরু করেঃ মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে এন্টাসিড এসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা ভালো করা শুরু করতে পারে। আধাঘন্টা থেকে ৩ ঘন্টা পর্যন্ত এটা কাজ করে। এরপরে আপনার আবার এসিড রিফ্লাক্স হতে পারে। এছাড়া এন্টাসিড আপনার অন্ননালীর কোন ক্ষতি ভালো করতে পারে না। পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াঃ আপনি কতটুকু এন্টাসিড খেয়েছেন এবং কতদিন ধরে খাচ্ছেন তার উপরে সাইড ইফেক্ট বা পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে। যদি আপনি এটা মাঝেমধ্যে খান, তাহলে সাধারণত কোন সাইড ইফেক্ট দেখা যায় না। তবে কিছু কিছু মানুষের ডায়ারিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। যদি আপনার হার্টের কিংবা কিডনির কোনো সমস্যা থাকে তাহলে এন্টাসিড খাওয়ার আগে ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে নিন।

মন্তব্যঃ যদি কোন কিছু খাওয়ার কারণে আপনার সামান্য এসিড রিফ্লাক্স হয়, তাহলে এন্টাসিড সবচেয়ে ভালো অপশন। এটা খুব দ্রুত কাজ করে এবং এর সাধারণত ক্ষতিকর কোন দিক নেই। যদি আপনার এসিড রিফ্লাক্স খুব তীব্র হয় এবং সপ্তাহে দুইবারের বেশি হয়, তাহলে আপনার এন্টাসিডের চেয়ে শক্তিশালী ঔষধ দরকার। পাকস্থলীর এসিড উৎপাদনে বাধাদানকারী ঔষধঃ যদি এন্টাসিডে আপনার কাজ না হয়, তাহলে আপনি হিস্টামিন ব্লকার খেয়ে দেখতে পারেন। কয়েকটা পরিচিত হিস্টামিন ব্লকার হচ্ছে Renitid, Neotack ইত্যাদি। যেভাবে এটা কাজ করেঃ এসব ঔষধ আপনার পাকস্থলীকে বেশি এসিড উৎপাদন করতে বাধা দেয়। এর ফলে আপনার এসিড রিফ্লাক্স হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

যদি বিশেষ কোন খাদ্য খেলে আপনার এসিড রিফ্লাক্স হয়, তাহলে ঐ খাদ্য খাওয়ার একঘন্টা আগে একটা হিস্টামিন ব্লকার খেলে আপনার এসিড রিফ্লাক্স হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ঘুমানোর আগে এটা খেলে আপনার রাত্রে এসিড রিফ্লাক্স হবে না। যখন এটা কাজ করা শুরু করেঃ সাধারণত খাওয়ার একঘন্টার মধ্যে এটা কাজ করা শুরু করে এবং ১২ ঘন্টার বেশি কাজ করে। Gastroesophageal reflux disease (GERD) এর কারণে দীর্ঘকালস্থায়ী যে এসিড রিফ্লাক্স হয়, হিস্টামিন ব্লকার সেটাকে সবসময় ভালো করতে পারে না। স্বল্পমেয়াদী সুস্থ্যতার জন্য আপনি ২ সপ্তাহ পর্যন্ত হিস্টামিন ব্লকার ব্যবহার করতে পারেন। যদি এরপরেও আপনার সমস্যা থাকে, তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। সাইড ইফেক্টঃ সাইড ইফেক্ট হিসেবে ডায়ারিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথা ঘোরা এবং ঘুম ঘুম ভাব দেখা দিতে পারে।

মন্তব্যঃ মাঝারী টাইপের এসিড রিফ্লাক্সের জন্য হিস্টামিন ব্লকার ভালো কার্যকারী। এসিড রিফ্লাক্স যেনো না হয়, সেজন্য এটা আপনি এসিড রিফ্লাক্স হয় এমন খাদ্য খাওয়ার আগে খেতে পারেন। তবে আপনার যদি তীব্র এসিড রিফ্লাক্স হয় কিংবা ২ সপ্তাহের বেশি সমস্যা করে তাহলে আপনার আরো শক্তীশালী ঔষধ দরকার।

পাকস্থলীর এসিড ভালো করার আরেকটি উপায় : যদি এন্টাসিড এবং হিস্টামিন ব্লকারে আপনার সমস্যা সমাধান না হয় কিংবা এসিড রিফ্লাক্স যদি ঘনঘন এবং তীব্র আকারে দেখা দেয়, তাহলে আপনি proton pump inhibitor (PPI) নামক একটা ঔষধ খেতে পারেন। এগুলো পিল এবং ট্যাবলেট আকারে পাওয়া যায়। Esomeprazole (Nexium, exium, maxpro, sergel), lansoprazole (lansec, lanso, lantid), omeprazole (Seclo) ইত্যাদি হচ্ছে PPI এর কয়েকটা উদাহরণ।

যেভাবে এটা কাজ করেঃ আপনার পাকস্থলীতে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাম্প আছে যেগুলো খাবার হজম করার জন্য এসিড তৈরি করে। PPI কিছু পাম্পকে বন্ধ করে দেয়। এর ফলে আপনার পাকস্থলীতে কম এসিড তৈরি হয়। PPI এসিড রিফ্লাক্স ভালো করার একমাত্র ঔষধ যেটা খাদ্যনালী এবং আলসারের সমস্যাকে ভালো করতে পারে।

যখন এটা কাজ করা শুরু করেঃ এটা কাজ করা শুরু হতে চারদিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। যদি আপনার প্রতি সপ্তাহে দুইবারের বেশি এসিড রিফ্লাক্স হয়, তাহলে আপনি এটা প্রতিদিন একবার করে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত খেতে পারেন। তবে এতে যদি আপনার সমস্যা দূর না হয়, তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। ডাক্তার আপনাকে প্রতিদিন একবার করে চার থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত এটা খেতে বলতে পারে। অধিকাংশ মানুষের এতেই এসিড রিফ্লাক্স ভালো হয়ে যায়। ঔষধ খাওয়া শেষ করে দেয়ার পরে আপনার যদি আবার বুকে জ্বালাপোড়া হয়, তাহলে আবার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। খালি পেটে খেলে PPI সবচেয়ে ভালো কাজ করে। তাই সকালে খাবার খাওয়ার ৩০-৬০ মিনিট আগে এটা খাওয়া সবচেয়ে উত্তম।

সাইড ইফেক্টঃ স্টাডিতে দেখা গিয়েছে যে PPI ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া এটা নিতম্ব ভাঙা এবং ভিটামিন বি-১২ এর ঘাটতির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। একারণে ডাক্তারের সাথে কথা না বলে এটা ১৪ দিনের বেশি না খাওয়া ভালো। দীর্ঘদিন ধরে PPI খেলে রক্তে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং আয়রন কমে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।

মন্তব্যঃ এটা তীব্র হার্টবার্ণ ভালো করতে পারে। তবে প্রতিদিন একবার করে দুই সপ্তাহ এটা খাওয়ার পরে যদি আপনার সমস্যা ভালো না হয়, তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।

এসিড রিফ্লাক্সের জন্য টেস্ট এবং সার্জারি : জেনারেল প্রাকটিশনারের দেয়া ঔষধ খেয়েও যদি আপনার এসিড রিফ্লাক্স ভালো না হয়, তাহলে তিনি আপনাকে একজন স্পেশালিস্ট এর কাছে পাঠাতে পারেন। স্পেশালিস্ট চেক করবেন আপনার gastroscopy বা এরকম কোন রোগের কারণে এসিড রিফ্লাক্স হচ্ছে কিনা। ক্যামেরাযুক্ত চিকন একটা টিউব আপনার গলার ভিতরে ঢুকিয়ে এই পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া এসিড রিফ্লাক্স থামানোর জন্য স্পেশালিস্ট laparoscopic fundoplication নামক একটা অপারেশন করার পরামর্শ দিতে পারে। তবে এসিড রিফ্লাক্সের জন্য প্রায় কখনোই অপারেশন করার দরকার হয় না।

Related News