March 27, 2024 | 3:30 PM

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে মশাকে ‘আতঙ্ক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে- মশাবাহিত রোগে প্রতিদিন বিশ্বে ৩ হাজার লোক মারা যায়। বছরে মারা যায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ। রিপোর্ট অনুযায়ী ডেঙ্গুই মশাবাহিত রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মশাবাহিত রোগ নিরাময়ে সক্ষম হলেও প্রাণঘাতী ডেঙ্গু নিরাময়ে অনেকটাই অক্ষম।

মাঝামাঝি সময় মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। বিশেষ করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেকের মৃত্যু ঘটে। যে কারণে সরকারের জনস্বাস্থ্য বিভাগ ও সিটি কর্পোরেশন এ সময় মশা নিধনে সক্রীয় হয়। তবে তা কতটা কার্যকর এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ফলে মশার কামড় থেকে বাঁচতে জনসাধারণকে নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা নিতে হয়। আর তাতেই মশার কয়েল প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর পোয়াবারো! যদিও মশার কয়েল নিয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন।

পরীক্ষা করে দেখা গেছে, কীটনাশকবিহীন কয়েল মশার বিরুদ্ধে ২০ শতাংশ কার্যকর। তবে মাত্র দশমিক ২ শতাংশ অ্যানোথ্রিনযুক্ত মশার কয়েলে ৮৮ শতাংশ কার্যকর। সুতরাং মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে মশার কয়েলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

মশার কয়েলের উৎপত্তি কোথায়? এতে কী উপাদান রয়েছে? উপাদানগুলো শরীরের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর? যদি ক্ষতিকর হয়, তবে কেনো নিষিদ্ধ হয় না মশার কয়েল? জানা যায়, অন্য সবকিছুর মতোই মশার কয়েলের উদ্ভাবক দেশ হলো চীন। প্রাচীন চীনে চন্দ্রমল্লিকা ফুল থেকে প্রাপ্ত গুঁড়ো পাইরোগ্রাম, গাছের বাকল থেকে পাওয়া আঠা জাতীয় পদার্থের গুঁড়োর সঙ্গে মিশিয়ে মশা বিতাড়ক ধূপ তৈরি হতো। বর্তমানে কাঠের গুঁড়ো ও নারকেলের মালার গুঁড়োর সঙ্গে অ্যারারুটের মাড় মেশানো হয়। এক্ষেত্রে কাঠের গুঁড়ো ও নারকেলের মালার গুঁড়ো জ্বালানি হিসেবে এবং মিশ্রণকে জমাট করতে অ্যারারুটের মাড় ব্যবহার করা হয়। সবুজ রঙ হয় ম্যালাকাইট গ্রিন বা ক্রিস্টাল গ্রিন মেশানোর জন্য। মশার কয়েলের প্রধান উপাদান হলো পাইরোফ্রয়েড। এটা প্রাকৃতিক যৌগ পাইরোগ্রাম থেকে পাওয়া যায়। অ্যালেথ্রিন-এর মতো সমধর্মী যৌগ থেকেও পাওয়া যায়। ম্যাটেও অনুরূপ পাইরোফ্রয়েড থাকে। তবে তাতে অনবরত নির্দিষ্ট তাপমাত্রা প্রয়োগ করতে হয়। তাপ পেলে ম্যাটের পাইরোফ্রয়েড বাষ্পীভূত হয়। নিদির্ষ্ট তাপমাত্রা প্রয়োগের জন্য ম্যাটকে ম্যাটহিটারের হিটপ্লেটে রাখতে হয়। এর আসল সক্রিয় উপাদান হলো কীটনাশক ডিডিটি বা পিন্ডেনের মতো ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন, প্যারাফিনের মতো আরপ্যানো ফসফরাস যৌগ এবং কার্বন।

প্রায় সমস্ত মশার কয়েলের মোড়কে অ্যালেথ্রিন ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে। এর সঙ্গে ফেনল ও ক্রেসল- দুটি জৈবযৌগ ব্যবহার করা হয়। কয়েলে উপরোক্ত উপাদানগুলোর পরিমাণ মানুষের সহনীয় মাত্রার মধ্যেই থাকে বলে দাবি করে ব্যবসা করছে কয়েল প্রস্তুতকারক কোম্পানি। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কতগুলো কীটনাশককে মশার কয়েলে ব্যবহারের জন্য নিরাপদ বলে চিহ্নিত করলেও আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো মান নির্ধারিত হয়নি। কেবলমাত্র উন্নয়নশীল বিশ্বে মশা নিধনে ব্যবহৃত এই কয়েলের ভালো-মন্দ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো মাথাব্যথাও সেই। আর তাই ব্যবহারকারীদের উপর মশার কয়েলে উপস্থিত কীটনাশক ও অন্যান্য উপাদানের ক্ষতিকর প্রভাবের দিকে সাধারণ মানুষ ততোটা গুরুত্ব দেয় না। সম্প্রতি জার্মানির ল্যুরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞগণ এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তারা জানান, কয়েল তৈরিতে যে কাঠের গুঁড়ো ও নারকেলের মালার গুঁড়ো ব্যবহার করা হয়, তার ধোঁয়া এতোটাই সুক্ষ্ম যে তা সহজেই আমাদের শ্বাসনালী ও ফুসফুসের বায়ুথলির মধ্যে পৌঁছে সেখানে জমা হতে পারে। আর খুব সূক্ষ্ম হওয়ার জন্য কণাগুলো বাতাসেও কয়েকদিন ভাসমান অবস্থায় থাকতে পারে। অর্থাৎ মশার কয়েল নেভার বহুক্ষণ পরেও ঘরে অবস্থানকারী মানুষের শ্বাসনালীতে কয়েলের ধোঁয়ার কণা ঢুকতে পারে। এর ফলে ফুসফুসের বায়ুথলির কণায় রক্ত জমে যাওয়া থেকে নানা ক্ষতি হতে পারে। তাছাড়া অ্যালেথ্রিন মস্তিষ্ক ও রক্তের বিভেদকে ভেদ্যতা বাড়িয়ে দেয় বলেও তারা জানান।

মশার কয়েলের ধোঁয়া প্রতিটি মানুষের জন্যই ক্ষতিকারক। এই ধোঁয়া অনেক ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যার সৃষ্টি করে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স চাইনিজ র‌্যাকেট ও মশা মারার বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। যা থেকে নির্দিষ্ট তরঙ্গ বের হয়। এসব তরঙ্গ মশাকে আপনার কাছ থেকে দূরে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু এগুলো ব্যয়সাপেক্ষ। বিকল্প হিসেবে বাজারে যেসব লিকুইড, যা ইলেক্ট্রিক প্লাগে লাগিয়ে ব্যবহার করতে হয় সেগুলোর ক্ষতিকর দিক রয়েছে কিনা এ বিষয়ে এখনো গবেষণার কথা জানা যায়নি। তবে কয়েলের ধোঁয়া থেকে অনেক কম হবে এতোটুকু নিশ্চিত বলা যায়। সবচেয়ে ভালো হয়, সন্ধ্যার আগে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেওয়া। যাতে মশা বাড়িতে ঢুকতে না-পারে। আর মশারি টানিয়ে ঘুমানো সবচেয়ে ভালো অভ্যাস।